শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ১০:০৫ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
জাল জামিনে তিন আসামির কারামুক্তি, কারসাজিতে জড়িত কারা কর্মকর্তা

জাল জামিনে তিন আসামির কারামুক্তি, কারসাজিতে জড়িত কারা কর্মকর্তা

স্বদেশ ডেস্ক:

উচ্চ আদালতে একের পর এক ধরা পড়ছে জালিয়াতির ঘটনা। এতদিন এসব জাল আদেশ তৈরির পেছনে কিছু অসাধু আইনজীবী ও তাদের সহকারীর হাত রয়েছে বলে অভিযোগ আসে। তদন্তে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন আইনজীবী ও তাদের সহকারীর নাম উঠে আসায় তারা জাল-জালিয়াতির মামলায় আসামি হয়েছেন। তবে কারা কর্তৃপক্ষ কিংবা কোনো কারা কর্মকর্তা এসব জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে- এমনটা ছিল ভাবনার বাইরে। কিন্তু বাস্তবে এমন ঘটনাই ঘটেছে।

১৭ বছর আগে জাল জামিন আদেশ তৈরি করে কারামুক্তি পান হেরোইন পাচার মামলায় যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত তিন আসামি। এই তিন আসামির ভয়ঙ্কর জামিন জালিয়াতির বিষয়টি চলতি বছরের শুরুতে হাইকোর্টের নজরে আসে। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত

তদন্ত কমিটির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ওই জাল জামিন আদেশ তৈরি করে কারামুক্তির ক্ষেত্রে যশোরের তৎকালীন কারা কর্মকর্তারা জড়িত। তদন্তে যশোরের তৎকালীন জেল সুপারসহ তিন কারা কর্মকর্তার নাম বেরিয়ে এলেও তাদের মধ্যে দুজন ইতোমধ্যে মারা গেছেন। আর তৎকালীন জেলার জাকের হোসেন বর্তমানে হবিগঞ্জের জেল সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ জামিন জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত থাকার দায়ে গত রবিবার তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনটি আমাদের সময়ের হাতে এসেছে।

জানা গেছে, আড়াই কেজি হেরোইন পাচারের মামলায় ২০০১ সালের ১ সেপ্টেম্বর মাগুরার শালিখা থানায় তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ মামলায় ২০০৩ সালে আসামি গোলাম মোস্তফা, আবু বকর ও জালালউদ্দিনকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- ও ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন মাগুরার আদালত। দ-িত তিন আসামিকে ২০০৩ সালের ৪ মার্চ প্রথমে মাগুরা কারাগারে পাঠানো হয়। এর পর ওই বছরের ৮ মার্চ পাঠানো হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। ওই কারাগারে থাকা অবস্থায় সাজার বিরুদ্ধে ২০০৩ সালেই হাইকোর্টে আপিল করেন আসামিরা। কিন্তু ওই আপিল শুনানি না করে আসামিরা জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে কারামুক্তি পান। জাল জামিন আদেশে আসামি গোলাম মোস্তফা ২০০৪ সালের ৮ এপ্রিল এবং একই বছরের ১৮ এপ্রিল মুক্তি পান আবু বকর ও জালালউদ্দিন।

যেভাবে ধরা পড়ে এই জালিয়াতি : কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আবারও হেরোইন পাচারে জড়িয়ে পড়েন আসামিরা। ২০১৬ সালে রাজধানীর লালবাগ থানায় এক কেজি হেরোইন পাচারের অভিযোগে একটি মামলা হয়। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৫-এ বিচারাধীন। এ মামলায় ২০১৬ সালের ৭ এপ্রিল আদালতে হাজির হন আসামি গোলাম মোস্তফা। তখন তিনি আদালতে বলেন, আড়াই কেজি হেরোইন পাচারের মামলায় তিনি দ-িত হয়ে হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন। কিন্তু কোনো কাগজ দাখিল করতে পারেননি। এর পরই জেলহাজতে পাঠানো হয় তাকে। এবার আসামি গোলাম মোস্তফা জামিন চাইতে হাইকোর্টে আসেন। বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে তার জামিন আবেদনের শুনানিকালে ২০০৪ সালে জাল জামিন আদেশে কারামুক্তির বিষয়টি ধরা পড়ে।

সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সামিরা তারান্নুম রাবেয়া আমাদের সময়কে বলেন, ২০১৬ সালে লালবাগ থানায় করা মামলায় গোলাম মোস্তফা হাইকোর্টে জামিন চান। তখন আদালত দেখতে পান, ২০০৩ সালে করা আপিলের নথিতে হাইকোর্টের কোনো জামিন আদেশ নেই। তা হলে কীভাবে সে জামিন পেল, আর কীভাবে সে কারামুক্তি পেল? তখন জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। আদালত পরে এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কারা তা তদন্তের নির্দেশ দেন।

হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৮ মার্চ এক আদেশে উল্লেখ করেন, মাগুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (জেলা প্রশাসক) অফিস থেকে পাঠানো এক মেমো অনুযায়ী তিন আসামি যশোর কারাগার থেকে কারামুক্তি পান। কিন্তু ২০০৩ সালের ফৌজদারি আপিল ৮৮৩-এর অর্ডার শীট থেকে দেখা যায়, আপিলকারীরা কখনই হাইকোর্ট থেকে জামিন পাননি। সে ক্ষেত্রে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস থেকে তিন আসামিকে মুক্তি দিতে জেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠানোর আগে হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। হাইকোর্ট যেহেতু তাদের জামিন দেননি, সে ক্ষেত্রে ওই জামিন আদেশের ক্ষেত্রে ভয়াবহ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। আদালত সেদিন, এই তিন আসামির জাল জামিন আদেশ ব্যবহার করে যশোর কারাগার থেকে কারামুক্তির ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করতে স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইন সচিবকে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে হাইকোর্ট বেঞ্চের কাছে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। মাগুরার জেলা ও দায়রা জজ এবং মাগুরার জেল সুপারকে এ মামলার সব অরিজিনাল কাগজপত্র সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে দাখিলের নির্দেশ দেন। রেজিস্ট্রার জেনারেলকে জাল-কাগজপত্র সৃজনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এই তিন আসামিসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন এবং এই মামলা সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

তদন্ত প্রতিবেদন

হাইকোর্টের গত ৮ মার্চ দেওয়া আদেশের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব নাসরিন জাহানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর অনুবিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব (সিভিল-২) মো. আবদুল্লাহ-আল-মাসুম ও মাগুরার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. কামরুজ্জামান। এই তিন সদস্যের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন আসামির জামিন ও কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া সংক্রান্তে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে রক্ষিত ছাড়পত্র, জামিননামা এবং কয়েদি রেজিস্ট্রারে উল্লিখিত স্মারকগুলোর পত্রাদি বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়, মাগুরা হতে প্রেরণ করা হয়নি। কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, উল্লিখিত তিনজন আসামি যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত গুরুতর প্রকৃতির কয়েদি হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ জেলা ডাকঘর, মাগুরা হতে শুধু জিইপিযোগে আসামিদের জামিন সংক্রান্তে প্রাপ্ত পত্রাদির ভিত্তিতে জামিন আদেশের সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য বিধি অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়, মাগুরার সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ না করে প্রচলিত রেওয়াজ লঙ্ঘন করে তাদের মুক্তি প্রদান করেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মূলত যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের তৎকালীন কারা কর্মকর্তারা একটি যোগসাজশ প্রক্রিয়ায় জাল জামিননামা ও ছাড়পত্র সৃজন করে কয়েদি রেজিস্টারে সম্পূর্ণ বানোয়াট নোট প্রদানপূর্বক তিনজন আসামিকে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি দিয়েছিলেন মর্মে তদন্তে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তৎকালীন কারা কর্তৃপক্ষ ব্যতীত অন্যান্য দপ্তরের সংশ্লিষ্টতা প্রতীয়মান হয়নি। তিন আসামির জামিনে মুক্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন তৎকালীন সিনিয়র জেল সুপার আলী আকবর তালুকদার, জেলার মো. জাকের হোসেন এবং ডেপুটি জেলার মাসুদুর রহমান। তাদের মধ্যে আলী আকবর তালুকদার ও মাসুদুর রহমান মারা গেছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া তৎকালীন জেলার মো. জাকের হোসেন বর্তমানে হবিগঞ্জ জেলা কারাগারের জেল সুপার পদে কর্মরত আছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে তদন্ত প্রতিবেদনটি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে দাখিল করেছে তদন্ত কমিটি। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সামিরা তারান্নুম রাবেয়া জানিয়েছেন, তদন্ত প্রতিবেদনটি আমার অফিসে জমা পড়েছে। তবে এখনো হাতে পায়নি। আগামী ২৪ অক্টোবর এ বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। তখন প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করা হবে।

জেল সুপার বরখাস্ত

এদিকে জাল জামিন আদেশ ব্যবহার করে কারাগার থেকে তিন আসামি মুক্তি পাওয়ার ঘটনায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক জেলার জাকের হোসেনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের কারা-১ শাখার উপসচিব তাহনিয়া রহমান চৌধুরীর স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জাল জামিন আদেশ ব্যবহার করে তিনজন আসামি জামিনে মুক্তি পাওয়ার ঘটনায় হাইকোর্ট বিভাগের ক্রিমিনাল আপিলের আদেশ মোতাবেক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক জেলার জাকের হোসেনকে সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। সাময়িক বরখাস্তকালীন তিনি আর্থিক বিধিবিধান মোতাবেক খোরাকি ভাতা প্রাপ্য হবেন। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে এ আদেশ জারি করা হলো এবং এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

জানতে চাওয়া হলে জেল সুপার জাকের হোসেন বলেন, তিন আসামির বাড়ি যশোরে হওয়ায় তাদের যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এর পর তাদের জামিননামা দাখিলের পর মাগুরার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) ফরোয়াডিং পাঠায় রেজিস্ট্রি ডাকযোগে। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট থেকে আসামি জামিন পেলে এডিএমের দায়িত্ব থাকে তার সঠিকতা যাচাইয়ের। আর এডিএমের পাঠানো ফরোয়াডিং সঠিক আছে কিনা সেটি জেলা সুপার এডিএমকে ফোন করে সঠিকতা যাচাই করেন। এর পর জেল সুপার যে আদেশ দেন, সে অনুযায়ী আমি ব্যবস্থা নিই। তিনি আরও বলেন, এডিএমের পাঠানো ফরোয়াডিংয়ে মাগুরার পোস্ট অফিসের সিল ছিল, এডিএমের স্বাক্ষর ছিল। সব কিছু সঠিক ছিল বলেই মিলিয়ে আসামি ছেড়ে দিয়েছি। তিনি বলেন, এ তদন্তের ক্ষেত্রে আমার কোনো বক্তব্য শোনা হয়নি। বৃদ্ধ বয়সে আমার ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877